এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিকে নিয়ে পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে,- বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্ন বীজ মূলত বপন করা হয়ে ছিল সেই -১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ে। ১৯৪৭ এর পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন দেখা দিতো ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য মূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতিসহ ইত্যাদি বিষয় নিয়েই আন্দোলনের যাত্রা অনেক ত্বরান্বিত হয়ে ছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন সংগ্রাম- ১৯৭১ সালে এসেই যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেছিল। অতএব বাঙালিরা অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সৃষ্টি করে ছিল বাংলা ভূখন্ড। ১৯৭১ সালে মার্চ ছিল- উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর এবং অনেক ভয়ংকর। ২৫ মার্চ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে খুবদ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আর তিনি গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এই বাংলাদেশের 'স্বাধীনতা ঘোষণা' করেও যান। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই যেন- মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধেই তীব্র থেকে তীব্রতর উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধু রাষ্ট্র সমূহের সর্বাত্মক সহায়তা বা বিশ্বগণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকাসহ ৩০ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে "স্বাধীন হয় বাংলাদেশ"। এ দেশের তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলে আরো একটু বিস্তারিত আলোচনার দিকে যেতেই হবে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ- বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও যোজন-যোজন দূরত্ব সত্ত্বে শুধুমাত্রই ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশকে নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান।

অদ্ভূত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই যেন সৃষ্টি পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার আর সর্বক্ষেত্রেই অনেক বৈষম্য-বঞ্চনার স্বীকার হয় "বাঙালি জাতি"। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয় বাঙালি সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ওপরে নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের ১ম গভর্নর- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তখনই ‘সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতিই- পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। ১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা যেন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে।বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা ছাত্রজনতাদের মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হয়ে ছিল:- রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত সহ আরও অনেকে। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন আজ বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার ছবিও এঁকে দেওয়া হয়েছে। এই বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের অজস্র রক্তের বিনিময়েই যেন অর্জিত স্বাধীনতা, যা কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতেই যেন পথ না হারায়, সেই প্রচেষ্টায় থাকতে হবে। অন্যথায় এই স্বাধীনতার ভাব-মূর্তি অনেকাংশেই ক্ষুণ্ণ হবে কিংবা বাঙালি জাতিদের ভাগ্যেও অশনিসংকেত দেখা দিতেই পারে বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাঙালি জাতি'রা যেন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

বলতেই হয় এমন দেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্তপূরণ করার এক বৃহৎ সক্ষমতা অর্জন করেছে। সব জাতি গোষ্ঠীরা মিলে মিশেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই তো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ স্বাধীনতার মূল্যবোধ রক্ষায় যত্নবান হওয়া যাবে। তবেই স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ। এইদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে অল্প কথায় শেষ করা যাবে না। আরো জানা দরকার ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে ছিল। আর মুসলিমলীগের অসহায় ভরাডুবিতেই নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালেও পুনরায় সরকারি ভাষায় নানা বিতর্ক, আইয়ুব খান- এর অপশাসন, পাঞ্জাবি কিংবা পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোর পূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কারণেই যেন বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ৬দফা দাবি উত্থাপিত হয়ে ছিল। গণ বিক্ষোভ প্রতিহত করতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে যেন স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপরেই চালাতে থাকে বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কালজয়ী নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানাকে মিথ্যা, সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ আর যারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটেই জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরে ক্ষমতা লিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কাল ক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু- শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে- এক বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিল, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, আরো বলেন, 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান'। এ উদাত্ত আহ্বানের জন্যই যে অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্রই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।