সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই যে তাঁর বেড়ে ওঠা। বাল্য বয়সে মস্তিষ্কের কোষেকোষে গেঁথে যায় যাত্রা দলের গান এবং যাত্রার বিভিন্ন মিউজিক। কৈশরে স্বরচিত গানের সহিত মিউজিক বাজানোর উৎসাহ ও সেসবের পরিচিতি ছিল মনের অনেক উর্ধে। সব কিছু ছাপিয়ে যাত্রা দলের 'ডুগী তবলা বাদ্যযন্ত্রকে নিয়েই যেন যাত্রা দল মাতিয়ে তোলে বাজানোর ঢংঙে। তরুণ বয়সে নিজ গাঁয়ের স্কুলে প্রতি বছর যাত্রা দল আসতো। মোঃ শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি সরকার শৈশব থেকে যেন যাত্রাদলের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন। যশোহরের সেই- 'জি, এস অয়েল অপেরা' যাত্রাদলটি ধানোরা প্রামে এলে তাঁদের সাথেই মিউজিক বাজিয়েছেন এবং শৈশবে মনেও করেছেন দলটির সঙ্গে চলে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু বাস্তবতায় বাবার কারণেই সেই সিদ্ধান্তের কবর হয়েছিল। তবে তাঁর বাড়ির পাশের একজন দক্ষ প্রবীণ ব্যক্তি উস্তাদ তাসির উদ্দীনের সঙ্গে এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ঘুরে ঘুরেই যেন মিউজিক বাজিয়েছেন। অনেক সুন্দর 'হারমোনিয়াম এবং অর্গান' বাজাতো উস্তাদ তাসির উদ্দীন। তাঁর সাথেই শফি'র উঠা বসা ছিল স্কুল জীবনে। উস্তাদ তাসির উদ্দীনের সঙ্গীতে ও বাদ্যযন্ত্রে পাগল হয়ে তাঁর সঙ্গে দূরদূরান্তের অনুষ্ঠানে গানের আসোবে ছুটে যেতো এবং সেখানে তাঁর নিজের লেখা গানগুলি গেয়ে আসোর জমাতো। ১২বছর বয়সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে 'উস্তাদ তাসির উদ্দীনের' সাথেই যাত্রার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় ৭/৮ বছর ধরে যাত্রা দলের বাদ্যযন্ত্র বাজিছেন। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের কাছে গান বা মিউজিক বাজানোটা তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়েই গিয়েছিল।
কিন্তু তাঁর, সে কংগো বা ডুগী-তবলার সহিত স্বরচিত গানগুলোর আধিক্যটা ছিল দর্শক জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তানোর থানার বিভিন্ন এলাকাতে তাঁর সুর কিংবা গানের জন্যেও বায়না এসে ছিল। কিন্তু এখন মিউজিক নিয়ে তাঁর কোনই পরিকল্পনা নেই। তবে মনের ইচ্ছা পূর্ণ করার বাসনা সর্বদাই জাগ্রত হয়, তা হলো স্বরচিত গান লেখা আর সে গানগুলি নিজ কন্ঠে গাওয়া। এই বিজ্ঞান চিন্তা চেতনায় মানুষ, অনেক সময় বহু ভাবনায় অগ্রসর হয়েছেন এবং বর্তমানেও সেসব ভাবনা নিয়েই আছেন। তার প্রতিফলন এমন গানটি। ''বিতার পড়ে বিজ্ঞান হলে সব কিছুতে মিল দেখায়,..গানের কথা শফিকুল বানার। আবার বিজ্ঞানীরা কি দেখায়,......গানের কথা শফিকুল বানায়। হাত বোমা তৈয়ারী করে খেলছে কত খেলা,...... মসজিদ ঘরে বোমা মারে,.......নাস্তিক হয়া সারারে দেখ নাস্তিক হয়া সারা।.... কিতাব পড়ে বিজ্ঞান হলে,...বোমা মারা কি দেখায়?...গানের কথা শফিকুল বানায়।....মহা শূন্যে বসত বাড়ি,.....বিজ্ঞানের তৈয়ারী,.....দেশ বিদেশে আকাশ পথে,.......দিচ্ছে তারা পাড়িরে দেখ দিচ্ছে তারা পাড়ি।...ওরে চাঁদের দেশে মানুষ গেছে,..হাদীসেতে তার প্রমান নাই।...গানের কথা শফিকুল বানায়।...চাঁদ আছে আর কতদূরে,...বিজ্ঞান তার উপরে।...ভিন্নগ্রহে জীবের সন্ধান,..বিজ্ঞানীরা বলে রে দেখ বিজ্ঞানীরা বলে। মঙ্গল গ্রহে মানুষ যাবে,...আর বেশী দিন দেরি নাই।.... গানের কথা শফিকুল বানায়'।.. এ ব্যতিক্রমী চিন্তা ধারার মানুষকে আরও পরে 'স্বরচিত গানের সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বহু গান শিখেছেন, তানোর থানার খুবই বড় গানের উস্তাদ- "মোঃ রেজাউল ইসলাম বাবু"।
উনার ডাকেই বিয়ে-বাদি, কিচ্ছা-কাহিনী, যাত্রা-পাটি এবং স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে স্বরচিত গান গেয়েছেন। তাঁর, বাবা মার হাজারো বাধা উপেক্ষা করে দীর্ঘ সময় এই জগতেই ছিলেন। একটু বলে রাখি, নেশা ও পেশার মধ্যে তাঁর যেন খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল। গ্রামীণ খেলা হাডুডু পাশাপাশি একই ভঙ্গিতেই- 'স্বরচিত গান' লেখার চিন্তা যৌবনকালে মাথায় নিয়েছিল অত্যন্ত তীব্র ভাবে। কিন্তু তখন 'কাগজে কলমে খাতায়' লিখাটা হয়নি। তবে শুরু হয়েছিল কলেজে ভর্তী হবার পর পর। বলা দরকার যে, তিনি লেখাপড়াতে অনেক ভালো ছাত্র ছিলেন। এস, এস, সিতে ছয় মার্ক পেলে অবশ্যই "প্রথম স্হান" অধিকার করতেন। তবে তাঁর কলেজ জীবনটাই নেমে আসে- অমানিশার ঘোর আঁধার, পড়া শোনা আর হয়নি। কাল হয়ে দাঁডিয়ে ছিল- "হুচি"। এইচ, এস, সিতে হুচি’ নামের মেয়ের সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে যান। কিরের আর লেখাপড়া, কষ্ট পেয়ে ছিলেন। বাবা, তাঁকে অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। হুচিকেও নিয়ে অনেক গান লিখেছেন। যেমন:- "কৃষ্ণচূড়া গাছেরে হুচি আজো বেঁচে আছে,...ভালোবাসার দিন গুলো সে কোথায় চলে গেছে।...পাড়ার যত তরুন মেয়ে খেলতো কতো খেলা,.. হাত ধরিয়া গোল্লাছুট আর কানা মাছির খেলা।.....ওরাই আমার সঙ্গের সাথী কোথায় চলে গেছে,.তাদের দেখতে মনে আমার বড়ই সাধ যে জাগে।... তাঁর নিজ ভাতিজা অর্থাৎ বড় ভাইয়ের বড় ছেলে "মোঃ আব্দুর রব" স্বচক্ষে দেখেছেন, অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই তাঁর উপলব্ধি, সত্যিই চাচা সংগীত রচয়িতা। প্রত্যক্ষদর্শীরাই উৎসাহ যুগিয়েন চাচাকে "স্বরচিত গানে জগতে" তাঁকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁরাই উঠিয়েছেন।
দর্শকনন্দিত এ স্বরচিত গানের শিল্পী শফি নজরুল ইসলাম তোফাকেও অনেক গান শুনিয়েছেন। তাঁর ভাতিজার ভাষ্যমতে বলা যায় যে, আমি চাচার একজন ভক্ত, আমার চাচা অত্যন্ত একজন গুনী ব্যক্তি। তাঁর স্বরচিত বহু গান আছে, আমি মনে করি সংগীত জগতের এক তৃনমূল বীর, আমি তাঁর লিখিত- 'গান, সুর, মিউজিক' বাজানোর পারদর্শীকতায় সত্যিই একজন খাটিভক্ত। খুব পছন্দ হয় চাচার স্বরচিত গান, আবার গাইতেও চেষ্টা করি চাচার নিজস্ব স্টাইলে। আব্দুর রব আরো বলেছেন যে, সব গান বিজ্ঞান চৈতন্য বোধের- 'ফোক সংগীত'। তাই ফোক সংগীতের রচয়িতা শফিকুল ইসলাম শফি প্রায় ৫০/৫৫ টি গান রচনার বড় এক খাতা হাতে করেই ঘোরে বেডান। সুতরাং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর মাষ্টার্স পড়ুয়া ভাতিজার তত্ত্বমতে তাঁর বহু গান সহ জীবনের বিভিন্ন ঘটনার প্রমান দিলেন।